সৌন্দর্য আপেক্ষিক। সৌন্দর্যকে তাত্বিকতার বাঁধনে যেমন বাঁধা যায় না, তেমন না পড়ে ধরা কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। তবে, মোনজগতের ল্যাবরেটরিতে তার ব্যবচ্ছেদ চলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। জৈবিকভাবে সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের যে অকৃত্তিম টান সেটাও আপেক্ষিক। আপেক্ষিক এর সমস্ত প্রকাশ ভঙ্গি। কারণ ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’। চোখের সাথে মনের যে অনুরণন তার বহিঃপ্রকাশ ভাবের উদয় করে। আর এই ভাবই হলো মানুষের প্রতি মানুষের সৌন্দর্যের ধারণা। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চোখের স্বাদ বদল হয়। বদল হয় মনের মনোস্তত্বের। সৌন্দর্যের এই বাহক ও ধারক যেখানে নিয়ত পরিবর্তনশীল। সেখানেই তৈরি হয় সৌন্দর্যের মূল রহস্য। সেখানেই মানুষে মানুষে ভেদ। আর সেখানেই জীবাত্মার কলহ।
আজ এই মনস্তত্বাত্তিক ভেদকে পুঁজি করেই হাজার হাজার বহুজাতিক কোম্পানি বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার ব্যবসা করে চলেছে। এই হাতিয়ার ব্যবহার করে দিনান্তে-পান্তাফুরোয় এমন হত-দরিদ্র মানুষের কাছ থেকেও হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তারা শিখিয়েছে ‘সৌন্দর্য মানেই ফর্সা ত্বক’, ‘সৌন্দর্য মানেই একটু বেশি সাদা চামড়া’। শুধু তাইই নয় এখন সৌন্দর্য মানে মুখ-অববয়ের ফর্সা প্রদর্শনী করার কারুকার্য শেখা। আর এই চর্যা তাদের মধ্যে চামড়ার রঙের মধ্যে এক ধরনের ভেদ তৈরি করতে শিখিয়েছে। তারা মনে করে সৌন্দর্য মানে ফর্সা কিছু। সৌন্দর্য মানেই ত্বকের বাহ্যিক প্রকাশ। এই ভেদের চর্চা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য এক বিশাল বাজার তৈরি করেছে। লক্ষ লক্ষ ক্রেতা-বিক্রেতার এক বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এটি।
১০০০ গ্রাম চাউলের সর্বোচ্চ গড় খুচরা মূল্য যেখানে ৬০ টাকা সেখানে ২৫ গ্রাম ফেয়ার এন্ড লাভলি বিক্রি হয় ৫৫ টাকায়। অর্থাৎ ১০০০ গ্রাম বা ১ কেজি ফেয়ার এন্ড লাভলি ২২০০ টাকা। যা কোন কোন পরিবারের এক মাসের খরচ।
এই ভেদের মোহ এক শ্রেণীর মানুষকে এতটায় গ্রাস করেছে যে, বাহ্যিক এই অপলাপ বাস্তবায়নে রীতিমত হুমড়ি খায়। একজন রিক্সাওয়ালা যে, দিনে তিন থেকে চার কেজি চাউলের টাকা রোজগার করতে খদ্দেরের আশায় সারাদিন কাটায়। তাকেও সপ্তাহ বা মাস শেষে তার মেয়ে অথবা গৃহবধূর জন্য ২২০০ টাকা দরে ফেয়ার এন্ড লাভলি বা এধরনের সৌন্দর্যবর্ধনকারী (দাবী করা হয়ে থাকে অথচ প্রকৃত অবস্থা ঠিক বিপরীত) দ্রব্য কিনে নিয়ে যেতে হয়। সদ্য যৌবনা মেয়ের জন্য একটি বই না নিয়ে নিয়ে যায় ফেয়ার এন্ড লাভলি।
বলা হয় ভেতরের সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য। মানুষ মনে যা ধারণ করে তাই তার সমস্তাঙ্গে প্রস্ফুটিত হয়। একজন আপাত কদাকার মানুষও যদি ভেতরের সৌন্দর্যে ভরপুর হয় তা অবশেষে আকর্ষণ করে। একজন সাদা চামড়ার ক্ষেত্রে একই রুপ ঘটতে পারে। অথচ এই সর্বজন সত্য সাধারণ ব্যাপারটিই এখন মানুষের কর্ণ-কুহোরে পৌঁছায় না। সবাই এখন দেহপূজারী আদম। তাই, ফেয়ার এন্ড লাভলির ব্যবসা রমরমা। আর মনের সৌন্দর্যবর্ধনকারী বইয়ের প্রকাশনাগূলো মারখায়।
–বোরজাহা