‘নারী-নিরাপত্তা’ বলে আলাদা কিছু নেই

‘নারী-নিরাপত্তা’ বলে আলাদা কিছু নেই

নিরাপত্তাহীনতার কোন জাতপাত বা লিঙ্গ ভেদ নেই। আর সেটা যদি হয় সামাজিক। তাহলে সেই সমাজে থাকা সবার জন্যই সেটা প্রযোজ্য। আমাদের এখানে এখন ‘নারী-নিরাপত্তা’ বলে একটি নতুন প্রপঞ্চের বেশ ব্যবহার হচ্ছে। এ প্রপঞ্চের মুল কথা হল- নারীর জন্য আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রকৃত অর্থে কোন সমাজে যখন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয় সামনে আসে। তখন সেটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। ব্যক্তি বা লিঙ্গ ভেদে তা হয় না। ধরুন ঢাকার কোন নির্জন গলি দিয়ে রাত একটার দিকে আপনি হাটছেন। একাকী। বিপদে কাউকে পাওয়ার ও সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় আপনি কী ঘাবড়ে যাবেন না? আপনার কি ভয় লাগবে না? নিশ্চয় লাগবে। ভয়ের কারণ কী? কারণ, যে কোন সময় কোন ছিনতাইকারী বা অপরাধী আপনার সামনে এসে পড়তে পারে। ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে আপনার মূল্যবান সব কিছু। এমনকি আপনাকে আহত বা খুন ও করতে পারে। এমন ভাবার কারণ হল- আপনি জানেন যে, এই শহরে এমনটি আহরহই ঘটছে। আপনি এই শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু আপানার যায়গায় যদি একজন নারী হয়? সে অবস্থায় সে তো নিরাপদ নয়ই। কারণ, অমন কোন যুবক বাড়তি হিসেবে চাইবে তাঁর সম্ভ্রম ছিনতাই করতে। এরাও ছিনতাই কারী। এদের ছিনতাইকারী বলছি কারণ, এরা সমাজের মূল্যবোধ ছিনতাই করে। এমতাবস্থায়, সবাই তাঁর এতো রাতে বাইরে কী এই প্রশ্নই তুলবেন। আসলে বিষয়টা তা নয়। আসল ব্যাপার হল নিরাপত্তাহীনতা।  আমরা কেউই নিরাপদ নই। নিরাপদ নয় আমাদের পরিবার। আমাদের সন্তান-সন্ততি।

নারীর প্রতি আমাদের আচরণ মুল্যবোধেরও মাফকাঠি। নারীর সম্ভ্রম হানী হলে সেটা ওই বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবারের জন্যই ক্ষতি বা লজ্জার নয়। সেটা পুরো সমাজ বা দেশের জন্য লজ্জার, অপমানের।

নিরাপত্তা একটি সমাজের মেরুদণ্ড। সমাজের নিরাপত্তা যত শক্তিশালী হয় সমাজের মেরুদণ্ড ও তত শক্তিশালী হতে থাকে। নিরাপদ সমাজ মানেই, শক্ত মেরুদণ্ডের সমাজ। আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। আমরা যদি এখনি সজাগ না হই, এই ভঙ্গুর সমাজে চাঁপা পড়েই মরতে হবে আমাদের।

তাই শুধু ‘নারী-নিরাপত্তা’ নয়, সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। আর সেটা করতে পারলেই আমাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

লেখকঃ তরিকুল ইসলাম

 

 

নারীর ওপর আঘাত মানেই সমাজের মননশীল ভিত্তিতে আঘাত

নারীর ওপর আঘাত মানেই সমাজের মননশীল ভিত্তিতে আঘাত

tonu“সে যুগ হয়েছে বাসি,

যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো,

নারীরা আছিল দাসী,” কাজী নজরুল তাঁর নারী কবিতায় এমনটিই ভেবেছিলেন। কিন্তু বাস্তাবে সেটি কতদূর? আমাদের সমাজ কি সে অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছে? আদৌ কী আমাদের সমাজ সেটির জন্য প্রস্তুত? যদি নাই হবে, তাহলে আর কতদূর? এই সমাজে আর কত বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে নারীকে?

একটি সমাজে কতটা সহনশীল, কতটা সভ্য। তা সে সমাজে বসবাসকারী নারীদের প্রতি সমাজের মানুষের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বোঝা যায়। একটা সমাজ বসবাসের জন্য কতটা উপযুক্ত তারও মাফকাঠি সেই নারী। নারীর ওপর আঘাত মানেই সমাজের সবচেয়ে মননশীল ও অহিংস ভিত্তির ওপরই আঘাত। মৃত্যু মুখাপেক্ষী একটি সমাজের কফিনে এইটিই শেষ পেরেক বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই ধরনের আঘাত তখনি আসতে শুরু করে যখন সে সমজের পতন শুরু হয়। তখনি নারীর উপর বর্বরতা আসে, যখন সমাজের অপশক্তির উপাদানগুলো উঠান ডিঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।

নারীর ওপর আরবদের বর্বরতার কথা শুনেছি আমারা। সে সমাজে নারীকে জীবন্ত কবর দেওয়ার কথাও জানা যায়। এমন অবস্থা তখনি ঘটেছিল যখন সেটি বর্বরতা শেষ বিন্দুতে পৌঁছে। নারীর ওপর আঘাত আসতে থাকা মানেই, পতনের শুরু। আমারা কি সেই পতনোম্মুখ?

সেটা না হয় হল। তবে, এর পেছনের কারণটা কি কখন ভেবে দেখেছি? কেন এমনভাবে আমরা আমাদের মানসিক মননশীলতা হারাচ্ছি? কেনই বা আমাদের নৈতিকতা এমন বাজেভাবে মার খাচ্ছে? হয়তোবা এর উত্তর দেওয়ার জন্য আমারা আজো প্রস্তুত নই। প্রস্তুত নেই বলেই সোহাগীদের মা-বাবাদের এখনো বিচারের অপেক্ষায় থাকতে হয়। বিচার চাইলে তাদের মৃত্যুর হুমকি পেতে হয়। বিচারের জন্য ঘুরতে হয় দুয়ারে দুয়ারে। অন্যপক্ষে, দোষীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সমাজকে শাসায়। শাসন করে।

এর উত্তর আমাদের খুঁজতেই হবে। এই সামাজিক অসভ্য উপাদানের মূলোৎপাটন করতেই হবে। না হলে কারোর রেহাই নেই।

নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর হত্যার প্রতিবাদে দেশের কিছু মানুষ সংঘবদ্ধ হতে চলেছে। গুটি কয়েক মানুষ নিয়মিত সোহাগীর বিচারের জন্য কর্মসূচী করে যাচ্ছে। গুটি কয়েক মানুষ বলছি কারণ কোটি কোটি বুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকের তুলনায় সেটা সামান্যই। প্রশ্ন হল- কেন সবাই নয়? এমন স্পস্ট অন্যায়ের প্রতিবাদেও কেন আমরা পিছপা?

সাবধান। এটিই শেষ নয়। তোমারা যারা ঘরে বসে আছো। তোমরাও রেহাই পাবেনা। কারণ, সামাজিক বর্বরতা কোন নিয়ম মেনে চলেনা। তুমিও কোন নারীর সন্তান, কোন নারীর ভাই অথবা কোন নারীর প্রিয়তম স্বামী। তোমার ঘরে নারী আছে। কোন নারীর প্রিয় মমতায় তোমার সকালটা সুন্দর হয়ে উঠে। আজ যদি আমারা না পারি। এ বিপদ আমাদের সাবাইকে গ্রাস করবে।

এরকম ঘটনা ঘটলেই কেউ কেউ রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বিক্ষুদ্ধ হয়। কিন্তু রাষ্ট্র কি আমা বিনা ভিন্ন কিছু? রাষ্ট্রের কী আলাদা কোন ক্ষমতা আছে আদৌ? না। নেই। রাস্ত্রের স্বতন্ত্র কোন ক্ষমতা নেই। প্রাথমিক সমাজ বিজ্ঞ্যানের ভাষায়- কয়েকজন জন মানুষ নিয়ে পরিবার। এই পরিবারের সমষ্টি একটি সমাজ। আর সেই সমাজের বৃহৎ পর্যায় হল   রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সেই সমাজের ভেতরটাকে প্রতিফলিত করে। তবে, একথাও সত্য যে, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কেন্দ্রীক রাষ্ট্র হতে পারে। তবে, সেটা ক্ষণস্থায়ী। সেটাও জনগণের ম্যান্ডেট মানতে বাধ্য থাকে। সবকিছু নির্ভর করে আমদের স্বদিচ্ছার ওপর। আসুন ভেতরের মননশীলতাকে জাগিয়ে তুলি। রাষ্ট্রের কথা চিন্তা না করে নিজেরাই রুখে দেই এসব ধ্বংসাত্মাক উপাদান। তাদের দাম্ভিক বিচরণ।