নদীর অ ব স

নদীর অ ব স

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বলেছেন, ‘জলই প্রকৃতির গাড়োয়ান’। আর পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে সেই গাড়োয়ানের বাহন হিসেবে কাজ করছে নদী। নদীই পাহাড় থেকে সে জল বয়ে নিয়ে গেছে দেশ হতে দেশান্তরে। সময়ের পরিক্রমায় নদী হয়ে উঠেছে প্রকৃতি ও মানব সভ্যতার শ্বাস্বত ত্রাতা। নদী যে শুধুমাত্র একটি প্রবাহ নয়; সেটা আজ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই  প্রক্রিয়ায় নদী মানুষের জীবনে নানা ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক, ব্যবহারিক ও সামাজিক — এই তিন উপায়ে।

যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নদী সহজলভ্য ও সহজতর করেছে আমাদের যাতায়ত ও পন্য পরিবহণ। সমৃদ্ধ করেছে আমাদের অর্থনীতিকে। সুন্দর করেছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে বৈচিত্র। এক অঞ্চলের মানুষের সাথে অন্য অঞ্চলের মানুষের সহজ যাতায়ত ঘটিয়ে রঙিন করে তুলেছে আমাদের সংস্কৃতি ও আমাদের পারস্পারিক বন্ধন। ফলে, একটি সুন্দর সমাজ গঠনেও নদীর ভূমিকা অনন্য।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, উল্টো আমরা নদীকে সরিয়ে দিয়েছি আমাদের কাছ থেকে। মোহ ও অতিলোভ আমাদেরকে নদীর এই ত্রি-তন্ত্র থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। ফলে, মরে যাচ্ছে নদী। নদীর পরিবর্তে আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি অন্যান্য ব্যবস্থার উপর। আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীটা হয়ে পড়ছে বসবাসের অযোগ্য। হারিয়ে যাচ্ছে জীব-বৈচিত্র। প্রাণের অস্তিত্ব। অথচ নদীই একমাত্র সহজলভ্য ও নিরাপদ উপায়।

প্রতি ২৪ ঘন্টায় আমরা ১৫০-২০০ ধরনের গাছ, পোকামাকড় পাখি ও জন্তু হারাচ্ছি। যার অধিকাংশ তাদের আবাসভূমি দখল ও দূষণের ফলে।

River 2

একসময়ে এদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০-১,০০০। এখন তার অর্ধেকেরও বেশি নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। দিনে দিনে যে হার জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বেশি দিন নয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশের নদীর দূরত্ব ছিল ২৪,০০০ হাজার কিলোমিটার। দেশে উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা নদী মেরেছি। গত কয়েক দশকে আমরা কয়েক হাজার কিলোমিটার নদী হারিয়েছি।

বর্তমানের পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগের নাম জলবায়ু পরিবর্তন। যে ঝড়ে পৃথিবী আজ টালমাটাল। এসডিজি-এর ১৩ নম্বরে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রতিকারের উপায়। এই ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবেলায় নদী হতে পারে মহা এন্টিবায়োটিক।

সম্পূর্ণ ক্ষত সারানো সম্ভব না হলেও বেশ কিছুটা সম্ভব। আর তার জন্যেই প্রয়োজন নদীর অর্থনৈতিক, ব্যবহারিক ও সামাজিক প্রত্যাবর্তন। এই তিন উপায়েই ফিরতে পারে নদী। আমরা যদি নদীকে এই তিন উপায়ে নিজেদের জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারি। আবার সব নদীতে ভাসবে পালতোলা নৌকা। সমৃদ্ধ হবে আমাদের পরিবেশ। ফুলে ফলে ভরে উঠবে এই প্রিয় প্রতিবেশ।

 

নারী সহিংসতামুক্ত একটি দিন চাই!

নারী সহিংসতামুক্ত একটি দিন চাই!

 

নারী কে?

এ প্রশ্নের উত্তর অনেক রকম হতে পারে। কারণ, একজন নারী তাঁর জীবদ্দশায় অনেক নামেই পরিচিত হন। কখনো মা, কখনো বোন, কখনো স্ত্রী, আবার কখনো বা বন্ধু। সমাজ বা পরিবারে নানা সম্পর্কের জালে আবদ্ধ একজন নারী।

এই প্রতিটি সম্পর্ক একেকজন নারীকে নানান দায়িত্বের চাপে আবদ্ধ করে ফেলে। আর এই প্রতিটি সম্পর্কের খাতিরে নারীকে স্বীকার করতে হয় অনেক ত্যাগ। সন্তান জন্মদান, তাদের লালন-পালন, পরিবারের দেখাশোনা—সব এক হাতেই সামলান এই নারীই। আর কর্মজীবী হলে তো কথাই নেই। জীবনবাস্তবতা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

কিন্তু এই মায়া বা সম্পর্কের বাঁধনও তাঁকে ধর্ষকের পাশবিক নির্যাতন থেকে বাঁচাতে পারেনি। পারছেও না।এমনকি এই ধর্ষকেরা কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য; যারা আমাদের এ সমাজেরই অংশ। সে মায়াময় বাঁধনও তাদেরকেও এই জঘন্ন কাজ থেকে বিরত রাখতে পারছে না।

প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই পাওয়া যায় এক বা একাধিক ধর্ষণ বা নারী প্রতি সহিংসতার খবর। ধর্ষণের পর হত্যার খবর। ধর্ষণের পর আত্মহত্যার খবর। শিশু থেকে বৃদ্ধ—কেউ এই ভয়াল থাবার বাইরে নয়। কখনো নিকটাত্মীয়, আবার কখনো বন্ধু, আবার কখনো বা অন্য কেউ এ অপরাধে করছে। নারী যেন আজ কারও কাছেই নিরাপদ নয়।

১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে ৬৬৬ নারী ধর্ষণের শিকার হন।পরবর্তী দুই বছরে বেড়ে ২০১৬ সালে সে সংখ্যা ৮৪০ হয়। ওই তিন বছরে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৪৩৯ জন। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার কয়েক হাজার নারী।

এ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গড়ে দুই জনের ও বেশি নারী ধর্ষিত হয়। ২০১৬ সালে গড়ও একি রকম। ২০১৬ বছরে গণধর্ষণের শিকার হন ১৬৬ জন নারী।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক মাসে প্রায় প্রতিদিন নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের কোনো না কোনো সংবাদ আছেই। বাংলাদেশ জাতীর মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যানুযায়ী, এ বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের ২৮ দিনে ধর্ষণের শিকার হয় হন ৩৮ নারী। জানুয়ারীর ৩০ দিনে যে সংখ্যা ছিল ৫২ জন।

শুধু তাই নয়। গত ৬ মার্চ প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, রাজধানীতে চার বছরের কম বয়সী তিন বোন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

এটি শুধু সংখ্যাই নয়, যা আমাদের সহিংসতার মাত্রাও প্রকাশ করে। আমরা সবাই এর সঙ্গে জড়িত নই। তবে, এ ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার।

সমাজে নারী-পুরুষ মিলে যে সম্পর্কের বাঁধন, সে সম্পর্কের বাঁধন যেমনি তাদের রক্ষা করতে পারেনি এই নির্মম সহিংসতা থেকে; তেমনি পারেনি আমাদের কেউ সে অপরাধ করা থেকে বিরত রাখতে। বরং ধীরে ধীরে বীভৎসতার মাত্রাও বেড়েছে। বেড়েছে গণধর্ষণ।

২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

শিশুরাও এই পাশবিকতার বাইরে নয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ১৬১ দশমিক ৮১ শতাংশ। গণধর্ষণ বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ। ধর্ষণের পর হত্যার সংখ্যা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। ধর্ষণের চেষ্টা বেড়েছে ৩৮০ শতাংশ। উত্ত্যক্তকরণ বেড়েছে ৭৭১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। যৌন নিপীড়ন বা শ্লীলতাহানির ঘটনা বেড়েছে ২৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। (প্রথম আলোয় গত ২৮ অক্টোবর, ২০১৬ সালে প্রকাশিত)

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিশুদের ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি, বলাৎকার, উত্ত্যক্তকরণ, শিক্ষকের মাধ্যমে যৌন নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৭৫৪টি। (প্রথম আলোয় গত ২৮ অক্টোবর, ২০১৬ সালে প্রকাশিত)

তাহলে সমস্যা কোথায়? অনেকে অনেক মত দিতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত সমস্যা হলো আমাদের চিন্তায়। আমরা কি পেরেছি নারীকে সেই স্বস্তি দিতে? প্রাকৃত অর্থে আমরাই ব্যর্থ হয়েছি নারীবান্ধব সমাজ গড়তে।

১৬ কোটি মানুষের দেশ। যে দেশে নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় ১০০:১০০; সেখানে নারীর প্রতি পুরুষের এই সহিংস আচরণ মোটেও কাম্য নয়। বরং এখানে সবার অবদান সমান হবে সেটাই কাম্য।

সেজন্য ধর্ষণমুক্ত একটি দিন চাই। একটি দিন, যেদিন নারীর প্রতি কোনো ধরনের নির্যাতন হবে না।

আমাদের উদারতা, সচেতনাতা ও সহিষ্ণুতাই হতে পারে এর উপযুক্ত হাতিয়ার।

 

 

 

 

জীবনে হতাশ হওয়ার সুযোগ কতটুকু?

No to frustration

হঠাত করে জানতে পারলেন আপনার বাবার লিভার সিরোসিস হয়েছে। তিনি জীবন মৃত্যুর সন্দিক্ষণে। আপনি কি হতাশ হবেন? বলবো না । এর মধ্যেই শুনলেন আপনার এই ভারাক্রান্ত হৃদয়ের ভার বহনে অক্ষম হয়ে, অথবা এর ভবিষ্যৎ ভার বহনের ভয়ে, আপনার প্রিয়তমা আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। আপনি হতাশ হয়ে পড়বেন? তারপরও বলবো না ।

এরপর পরই শুনলেন আপনি আপনার জব হারিয়েছেন। বস বলে দিয়েছে ‘কাল থেকে আর অফিসে এসো না’। আপনি কি হতাশায় ভেঙ্গে পড়বেন? তারপরও বলবো না, হতাশ হবেন না । ইতোমধ্যে খবর এলো আপনার প্রাণ প্রিয় মাতাও অসুস্থ। খুব জরুরি চিকিৎসা করা প্রয়োজন তাঁর। অথচ আপনার পকেটের শেষ টাকাটাও শেষ। আপনার পুঁজি বলতে যা ছিলো সেটাও সেই পারিবারিক খরচের খাতায় উঠে গেছে। প্রতিবেশি, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আত্মীয় বলতে এমন কেউ নেই যে হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। আপনি কি হতাশ হবেন?

আমি উত্তরে বলি, না। হতাশ হবেন না। কারণ আপনার সমস্যার যেমন শেষ নেই। সম্ভাবনারও শেষ নেই। এরপরও আশা থাকে। আমি ইশ্বরের কথা বলছিনে। বাহ্যিক বাৎচিত তাঁর সাথে প্রয়োজন হয় বলে মনে করি না। অন্তরের উপলব্ধি আমার কামনা। যেহেতু তিনি সর্বজ্ঞ।

ইশ্বরের মতন আছেন তাঁর অনেক প্রতিনিধি। আপনারও অজান্তে যারা আপনাকে প্রচণ্ড স্নেহজ্ঞান করেন। আছে কোন একজন ভালো মানুষ। আপনাকে অবাক করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিবে তিনি। এগিয়ে আসবে আপনার একান্ত সাহায্যে।

তাই বলি, হোকনা জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর। ভেঙ্গে পড়বেন না। জীবন চলে যাবে। জীবন চলে যায়—এটাই বড় সত্য। তাই, আর যাইহোক জীবনে হতাশ হওয়ার সুযোগ কম। নেই বললেই চলে।

আমাদের দেশের ডাক্তারদেরও কি চিকিৎসা প্রয়োজন?

 

Doctorগত কয়েক মাস ডাক্তারের কাছে দৌড়ে একটা অভিজ্ঞতা ও একটা উপলব্ধি হয়েছে। উপলব্ধি হল স্বয়ং ডাক্তারদের অসুস্থতা আর অভিজ্ঞতার নাম ভুগান্তি। এই অভিব্যক্তি সরকারি বেসরকারি স্বনামধন্য হাসপাতাল মিলিয়ে।

এই মহান পেশার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেই বলছি—আমাদের দেশের ডাক্তারদের জন্য একটা চিকিৎসালয় জরুরি হয়ে পড়েছে। ডাক্তারদের এই অসুস্থতা একজন রোগির মতই তাদের নিজেদের ও পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। মহামারি আকার ধারণ করার আগে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ, সাপের চেয়ে গিরগিটির জিহ্বা লম্বা হলেও সাপই বেশি ভয়ংকার। বিগত কয়েকমাসে মনে হল, সবাই কোন না কোন ভাবে মানুসিকভাবে অসুস্থ। এই মানুসিক অসুস্থতা তাদের আধ্যাতিক চিকিৎসক বানিয়ে দিয়েছে। রোগীর নাম শুনেই তিনারা প্রেসক্রিপশন লেখেন। আমাদের দেশে আবার যেহেতু কেউ যতক্ষণ না কারো মাথায় লাঠি ভাঙ্গতে উদ্যত হচ্ছে। তাকে মানুসিক রোগী বলা বড় অন্যায়। তাই সেটা হয়তোবা ধোপে টিকবেনা। তবে ঘটনা সত্য। তাদের সঠিক চিকিৎসা হলে, প্রকৃত রোগীদের সঠিক চিকিৎসা হবে।

রোগী দেখার সময় এমন ভাবে কথা বলবে যে তাদের কথা বুঝতে রোগীরও ডাক্তারি পড়লে ভালো হত। তবে, সবাই এমন তা বলছিনে। কেউ কেউ এমন আচারণ করে যেন রোগী তার যন্ত্রণার কারণ। প্রতি বছর হাজার হাজার রোগী ভারতে চলে যাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে—সেবিকা ও ডাক্তারদের সুন্দর ব্যবহার। এটা শিখতে হবে।

এসব ছেড়ে, ডাক্তারদের কেউ অর্থের আবার কেউ মর্যাদার পেছনে ছুটছে। এদের কেউ কেউ ধান্দার পাগল। চাকুরির অবস্থান ও পদ বলে এই অসুস্থতা ভিন্ন ভিন্ন হয়। স্বনামধন্য যেসব বেসরকারি হাসপাতাল তাদের চিকিৎসকরা ঘন্টায় কত রোগী দেখা যায় সেটার জন্য উদগ্রীব। কত তাড়াতাড়ি কতজনকে বিদায় করা যায় সেটাই তাদের মুখ্য বিষয়। কারণ, একজনকে বিদায় করলেই, কমপক্ষে শ’পাচেক টাকা পকেটে তোলা যায়। আর সরকারি হাসপাতালে যারা আছেন, তাদের লক্ষ্য কত তাড়াতাড়ি রোগীদের বিদায় করা যায়। কারণ? শেষ হলেই তো ভাড়া খাটার সুযোগ তৈরি হবে। এক দৌড়ে অন্যকোন বেসরকারি হাসপাতালে যেয়ে উঠা যাবে। ত্রিশ টাকার রোগীর চেয়ে পাঁচশ টাকার রোগীর মুখ দর্শন কম সৌভাগ্যের নয়!

আর যিনি পদমর্যাদায় উচ্চ আসনে। তার তো কথায় নেই। ন্যানো সেকেন্ডেই রোগী দেখা শেষ করেন। কয়েক সেকেন্ডে রোগী দেখেন এমন একজন ডাক্তারের কথা বলছি। যিনি এখন ঢাকার এক সরকারি পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েট চিকিতসালয়ের কর্ণধর। যিনি পেশার খাতিরে কর্ণ ধরেনও বটে। আমার এক বন্ধুকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এই মহান আধ্যাতিক চিকিৎসক নেতা রোগীর নাম শুনেই ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। টিনের চালে কাক, আমি তো অবাক! এমন অনেক অবাক করা ঘটনা ঘটন পটীয়সী আমদের এখনকার মহান চিকিৎসকরা।

আরে তোদের টাকার প্রয়োজন এতো। যে টাকা দিয়ে পড়েছিস ওটা দিয়ে ব্যবসা করলিনা কেন? ধান্দা ভালো লাগে আমলা হলি না কেন? দেশের সম্পদ নষ্ট করে সেবক হতে গেলি কেন? এই পেশায় সেবা নামক যে ট্যাগ লাগানো হত, বোধ করি, সেটা না থাকলেই মানুষের উপকার হয়। মানুষ তাদের ঠাঙ্গানোর সুযোগ পেতো।

আমার বাবার চিকিৎসা করাচ্ছি একজনের কাছে। শুনেছি তিনি নাকি এই রোগীদের শেষ ভরসা। তিনিও সেমি-আধ্যাতিক ডাক্তার। যে ক্ষেত্রে স্বয়ং ইন্সপেকশনের প্রয়োজন। তিনি রোগীর মুখের কথা শুনে ভেতরের খবর জেনে যান। কারণ, তার তো লাভ পেছনে। সামান্য সন্দেহ হলেই, যাও টেস্ট করো। টাকা ঢালো। কারণ, তুমি যেখানেই টাকা ঢালবে, কমিশনের টুপাইস তার পকেটেই পড়বে।

তাই, বলি ভন্ডামি ছাড়ুন। দেশের মানুষের টাকায় পড়েছেন, তাদের মন দিয়ে সেবা করুন। সেটা না পারলে, পুঁজি জমিয়ে মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবসায় নেমে পড়ুন। টাকা বা ধান্দা কোনটারই অভাব হবে না।

এখন প্রশ্ন এসেই যায়। তবে, এমন কেন হল? একজন সেবক কেন ‘টাকা লোভী’ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। একজন ডাক্তারকে ডাক্তার হতে হলে অনেক চরাই উতরাই পার হতে হয়। সেবার মানসেই তো সে পড়তে আগ্রহী হয়। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা এই সমাজ নিজেই, নাকি শিক্ষা ব্যবস্থা কোন গলদ? একজন চিকিৎসক তো শপথ নিয়ে এ পেশায় আসে। কিসে তাকে এমন ভয়ঙ্কর বানিয়ে তোলে? সেটা বের করাও জরুরি। না করতে পারলে এই ব্যবস্থা টিকবে না। মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

এই নির্মমতার শেষ কোথায়?

Bodies are seen on the ground after at least 30 people were killed in the southern French town of Nice when a truck ran into a crowd celebrating the Bastille Day national holiday

Bodies are seen on the ground July 15, 2016 after at least 30 people were killed in Nice, France, when a truck ran into a crowd celebrating the Bastille Day national holiday, July 14, 2016. Photo: Reuters

নিসে ১০ শিশুসহ ৮৪ জনকে ট্রাক চাপায় নির্মমভাবে হত্যা করেছে এক বর্বর গোষ্ঠী। এটি সাম্প্রতিক গণহত্যা। ঠিক ১৩ দিন আগেই গুলশানে বর্বর ভাবে ২০ জন দেশি-বিদেশি জিম্মিকে হত্যা করা হয়। এর আগে ফ্রান্সে আরো কয়েক দফা হামলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে জিম্মি করে নির্মম হত্যা। তুরস্কে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণ, বেলজিয়ামে বোমা বিস্ফোরণ। আর এ ধরনের ঘটনা ইরাক বা আফগানিস্তানে তো নিত্য ব্যাপার হয়ে গেছে। এভাবেই চলছে গত কয়েক বছর। এখন প্রশ্ন হলো- এ নির্মমতার শেষ কোথায়?

ঐ গোষ্ঠীর পশুবৃত্তিক যুদ্ধ রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে। আর রাষ্ট্রের যুদ্ধ আইএস-এর বিরুদ্ধে। যুদ্ধ হচ্ছে। মারা যাচ্ছে শিশু, নারীসহ সাধারণ মানুষ। দিনে দিনে এই পাল্টাপাল্টি হিংস্রতা বেড়েই চলেছে। এক দল বর্বর দিনের পর দিন বর্বরতা চালাবে আর আমরা পৃথিবীর মানুষ কতকাল দেখবো? অথচ, পুরো পৃথিবী নয়। শুধু ইউরোপ আর মধ্যাপ্রাচ্যের মানুষ পায়ে হেটে গেলেই আইএস-এর রাক্কা মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যেত। আমারা কেন জাগতে পারছিনা? কিসে এত দ্বিধা? আমরা কি খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি? নাকি আমরা ঐক্যবধ্য হওয়ার কথা ভুলেই গেছি? নাকি আমাদের মধ্যেই ওরকম জঙ্গিবাদের বসবাস? কোনটা উত্তর সেটা আমাদের খুঁজতে হবে। তবে এটা সত্য যে, ধনতন্ত্রের আত্মকেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলে। আমরা ‘আমরা’ শব্দটা কিছুটা হলেও ভুলে গিয়েছি। এর করণ ধনতন্ত্রে নয়, আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। জন্ম থেকে আমরা ধনতান্ত্রিক না হলেও, আমরা কিন্তু (আস এন্ড দে) ‘আমরা এবং তারা’র বিভাজনটা শিখি জন্ম থেকে। ধনতন্ত্র এই ‘আস এন্ড দে’ এর প্রাতিষ্ঠানিক রুপ মাত্র। যা সামাজিক অনুশীলন থেকে আর্থিক অনুশীলনে প্রবর্ধিত হয়েছে মাত্র। কারণ ‘গাড়িটা আমাদের’ কমুউনিসম হলে, ‘গাড়িটা আমার’ হলো ধনতন্ত্র।

মানুষের বা পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর কোন কিছুর বিশ্বায়ন হলে আমরা সেটা সুফল পায়। একইভাবে সন্ত্রাসের মত কোন কিছুর বিশ্বায়ন সবাইকে আঘাত করে। সবার ক্ষতি সাধন করে। এটা এখন একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা।

এই বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশে কোন হামলা বা হত্যাকাণ্ড সেটা শুধু এ দেশর ক্ষতির কারণ নয়। তার ক্ষতিকর প্রভাব ইউরোপ, এমনকি সুদূর অ্যাটলান্টিকের ওপারে আমেরিকার উপর পড়তে পারে। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা বা ইউরোপে কোন বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটলে সেটার প্রভাব এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি বা সামাজিক মূল্যবোধকে আঘাত করতে পারে। কিন্তু আমরা কেন পারছিনা? আমরা ইতোমধ্যে আক্রান্ত। তবুও কেন পারছিনা?

বিশ্ব মোড়ল বলে যারা নিজেদের দাবি করেন এবং সে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের ভাবতে হবে ছোট্ট দেশ মালদ্বীপের বাসিন্দারা যেমন সারা পৃথিবী জুড়ে আছে। তেমনি বড় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে। আর্থিক বিশ্বায়ন যেমন সবার। সবার সহযোগিতা ছাড়া সেটা হয়নি।

আমরা এখন সন্ত্রাসের বিশ্বায়নের যুগে। আইএস, আল-কায়েদার বিস্তার সন্ত্রাসের বিশ্বায়নের উদাহরণ। গত কয়েক বছর ধরে আমরা সেটার ফলাফল দেখেছি। তাই, এই বিশ্বায়িত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ায় কারো একার নয়। এ যুদ্ধ সবার। সবাইকে নিয়ে এ যুদ্ধ করতে হবে। তাই, সবাই মিলে ‘বিশ্ব সলিডারিটি স্টেজ করুন’। মধ্যযুগের ইউরোপের বর্বরতা রোখা সম্ভব হয়েছিল ইউরোপের সামগ্রিক প্রচেষ্টার ফলে। মনে রাখতে হবে ৩০ বছরের ভয়ানক যুদ্ধও ‘ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তি’র মাধ্যমেই থামানো গিয়েছিলো। তাই, সন্ত্রাসের বিশ্বায়ন কোন নির্দিষ্ট জোট বা জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সবাইকে নিয়েই এই লড়ায় করতে হবে। তবেই সন্ত্রাসের বিশ্বায়ন থামানো সম্ভব। তাছাড়া নয়। এ সমাজ থেকেই তার উদ্ভব। এ সমাজের মানুষই পারে সেটার মূলোৎপাটন করতে। তার জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক ঐক্য।

বয়কট

boycottআচ্ছা আমরা এতো নির্লজ্জভাবে আত্মকেন্দ্রীক কেন? এমন ভয়াভহ সংকটের মূখে সবাই কীভাবে ঈদ পালন করতে পারি? সবাই কী এক জুলাইয়ের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটা ভুলে গেল? এ দেশের, এ জাতির ইতিহাসে যা এক ভয়ঙ্কর ঘটনাই নয়, অপমানেরও। জাতি হিসেবে অতীথি পরায়ণতায় আমাদের বিশ্ব জোড়া সুনাম ছিল। অথচ আমরা আমাদের সেই অতীথিদের বাঁচাতে পারিনি। তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এমন স্মৃতির পরও এ দেশে ঈদ হয়!

ঈদ সবার। মানি। তাই, ঈদ আজ আমার কাছেও এসেছিল। আমি সেটা বয়কট করেছি। সবাইকে না জানিয়েই করেছি। যে দেশে বন্ধি করে অথিতীকে হত্যা করা হয়। সেখানে আমার ঈদ হতে পারেনা। সেখানে আমি উল্লাস করতে পারিনা। আমার বিবেক বাঁধা দেয়।

জানি ও মানি এই নিরাবেগ প্রতিবাদে দেশ বা জাতির কোন কল্যাণ হবে না। তবুও নিজেকে তো শান্তনা দিতে পারবো। তাই, আমি সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। ক্ষমা চাইছি। মা-বাবা এবার অধীর আগ্রহে ছিল—তাদের ছেলে বাড়ি যাবে। এই ঈদ তাদের সাথে কাটাবে। আমি ক্ষমা প্রার্থী মা। আমায় ক্ষমা কর। আমি পারলাম না সে আনন্দের ভাগীদার হতে। আমার বিবেক আমাকে বাধা দেয়। জানি তোমাদের কস্ট হচ্ছে। তবুও ক্ষমা করো।

আমার বোনটিও এবার ভেবেছিল তার ভাই আসবে। আনন্দ ফুর্তি করে এবারের ঈদটিও কাটাবে। কিন্তু, আমি পারলাম বোন। আমাকে ক্ষমা করিস। আমি যে এবার ঈদের সমস্থ আনুষ্ঠানিকতা বয়কট করেছি।

আমার প্রিয়তমা। নিষ্পাপ ফুটফুটে একটা মেয়ে। যার আবেদন ফেরানো অনেক অনেক কঠিন। সেও ছেয়েছিল আমি যেন তার অথবা আমার পরিবারের সাথে ঈদ কাটায়। তার অন্তঃত এতুকুন চাওয়া ছিল– আমি যেন ঈদটা আনন্দে কাটায়। কিন্তু

সেটাও হলো না। আমি তোমার কাছেও ক্ষমা চাইছি। আমি পারলামনা প্রিয়তমা। আমার হ্রদয় প্রচণ্ড আঘাতে বিচূর্ণ। এখানে সুখের সন্ধান পেতে এখনো বেশ সময় লাগবে। সেদিনের বর্বর ঘটনা আমার ভেতরটা বিচূর্ণ করে দিয়েছে।

আমি এ সমাজকে ছাড়তে পারছি না। না পারছি শাসক শ্রেণীকে ঘৃণা ভরে উপেক্ষা করতে। আমার বাগস্বধীনতাটাও আজ প্রায় রুদ্ধ। লেখার সময় নিজেকেই সেন্সর করে লিখতে হয়। এই যে লিখছি, সেটাও বেশ সচেতন হয়ে। কারণ, কোন বাক্যে প্রভুদের কোথায় আঘাত লাগে সেটা ভাবতে হয়।

তাই, এবারের ঈদ আমি বয়কট করেছি। সমস্তে বয়কট করেছি। কোন ধরণের প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছাড়াই কাটিয়ে দিব এই ঈদ। তোমারা হয়তো ভাবছো আমি হ্রদয়হীন। সেটা সত্য নয়। কারণটা নজরুলই ভালো বলেছেন, বিধাতা সৃষ্টির সময় এক বিরাট গলদ করে ফেলেছিলেন–ভেতরটা বানিয়েছেন কাদার মত নরম, আর বাহিরটা পাথরের মত শক্ত। তাই আমারও হৃদয় কাঁদে। তবে প্রতিবাদের কান্নার রুপ ভিন্ন।

যারা নিজেকে এদেশের অবিভাবক দাবি করে হাসি ঠাট্টায় দিন কাটাচ্ছে। যারা এ বাংলা মায়ের জল, ভাত, অর্থ ভক্ষণ করে পশু জন্ম দেয়। যারা মায়ের বুক চুসে কাড়িকাড়ি বোনাস বেতন নিয়ে আনন্দ করছে। যেসব দাসের বাচ্চাগুলো সারাবছর দাসগীরি করে বুক উঁচিয়ে আজ উল্লাসে মেতে আছে। কারোর জন্য আজ ঘৃণা নয়। শুধু উপেক্ষা। তোমাদের এই আনন্দের বাইরে থাকাই আমার প্রতিবাদ।

মা, বাংলাদেশ, তোমাকে কেউ ভালোবাসেনা রে। ওরা সবাই তোমাকে ঠকায়। তাই, সব কিছু প্রতিবাদের আজ আমার এই সামান্য প্রতিবাদ। সেদিনের বর্বরতার জন্য। তোমার মানহানির জন্য আমি ক্ষমা চাই। ক্ষমা করো বাংলা মা। মঙ্গলে ভরে তোমার বুক। এই কামনা।

 

খেলার সাথীরা কোথায় আজ তোরা?

খেলার সাথীরা কোথায় আজ তোরা?

“খেলার সাথীরা কোথা আজ তারা? ভুলিয়াও গেছি নাম,” ছোট বেলার খেলার সাথীদের স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে বেগম সুফিয়া কামালের ‘”পল্লী স্মৃতি” কবিতার এদুটো পঙক্তিই যথেষ্ট। যারা গ্রামের পল্লী মায়ায় বেড়ে উঠে ভাগ্য অন্বেষায় এই যান্ত্রিক ঢাকায় ভীত গেড়েছেন। তাদের জন্য সে স্মৃতি আজ ভোলার নয়। সেটি আজো অম্লান।

ছোট বেলার খেলার সাথীদের কথা ভাবলেই, মনের মাঝে ভেসে উঠে শেষ বিকেলের ছুটোছুটি। বৈশাখের ঝড়ে আমকুড়ানো। গ্রীষ্মের দুপুর। তাড়াতাড়ি স্কুলের হাতের লেখা শেষ করে, দাড়িয়াবান্ধা বা বউচি খেলায় মেতে ওঠা। সদ্য ফসল তোলা হয়েছে এমন কোন ক্ষেতে দাড়িয়াবান্ধা খেলার জায়গা নির্বাচন করা। পানি-মাটি দিয়ে সেটাকে খেলার উপযোগী করা। খেলার কোর্ট তৈরী হলে গেলে। সূর্যের শেষ আলো টুকুন থাকা পর্যন্ত চলত খেলা। আবার কখনো নির্জন কোন রাস্তায় ডাংগুলিতে মেতে ওঠা। কখনো বা মার্বেল বল খেলা। এভাবেই কেটে যেত সে বিকেলগুলো।

হার জিতের সাথে সাথে সে সব খেলায় আরেকটি অপরিহার্য বিষয় থাকতো। খুনসুটি বা মোনমালিন্য। তবে, সেটার ব্যাপ্তি থাকতো সন্ধ্যা অবধি। মোনমালিন্যের মাত্রা বেশি হলে সেটা বড়জোর পরেরদিন খেলার আগ পর্যন্ত গড়াতো। এর বেশি নয়। ফি দিন বিকেলে সব ভুলে আবার সেই খেলায় মেতে ওঠা।

বৈশাখের দুপুরগুলোতে রোদ লেগে আসুখ করবে বলে। মা বাইরে থেকে দরজা আটকে ঘুমোতে বলতো। মা ঘুমোনোর আগপর্যন্ত চুপ করে শুয়ে থাকতাম। মা ঘুমিয়েছে মনে হলেই কাউকে দিয়ে দরজা খুলিয়ে দেওয়ার জন্য জানালা পাশে ঠাই বসে থাকতাম। কিছুক্ষণের মধ্যে খেলার সাথীদের কারো সাথে দেখা মিলে যেত। দরজা খুলতেই চম্পট। আর সন্ধ্যা অবধি কোন খোঁজ মিলত না। সন্ধায় চুপি চুপি এসে পড়ার টেবিলে বসে যেতাম। এটাই ছিল সাধারণ নিয়ম।

মাঝে মাঝে আমাকে খুঁজে না পেয়ে মা খুব চিন্তায় পড়ে যেত। খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে আসতো। বকা দিত। মাঝে মাঝে মারতোও। তবে, সেটার ইফেক্ট সকাল হওয়া পর্যন্ত। সকালে মারের দাগ ছাড়া কিছুই থাকতো না মনে।

বৈশাখী ওই পালানো দুপুরে বন্ধুরা মিলে একটা নির্জন জায়গা খুঁজে বের করতাম। এমন জায়গা যেটি মার জন্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রতিদিন আমাদের নতুন নতুন এলাকা বা জায়গা নির্বাচন করতে হত। কারণ বুঝতেই পারছেন। মার হাতে সহজেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। প্রথম পর্বে চলত মার্বেল বল খেলা। কিছুক্ষণ পর সূর্যের তাপ কমে আসলে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রিকেট অথবা ফুটবল খেলা চলতো।

বৈশাখের বিকেলগুলোতে খেলার মধ্যে মাঝে মাঝে ঝড় উঠটো। ঝড় আসা অর্থ খেলা বন্ধ করে আম গাছের নিচেই দৌড়। দমকা হাওয়া দেখলে, মরিচ, লবন ও কাসন বাটা দিয়ে মাখানো কাঁচা আমের ঘ্রাণ নাকের সামনে ভাসতে থাকতো। বৈশাখী বাতাস মানেই আম কুড়ানোর উপলক্ষ।

অন্য দিনে খেলা করলেও স্কুল ছুটির দিন চলত অন্য আয়োজন। বৈশাখ মাসে বিলের পানি একেবারেই কমে আসতো। খুব ভোরেই সবাই মিলে বেরিয়েও যেতাম বাইন আর শিং মাছ ধরতে। দুপুর পর্যন্ত মাছ ধরে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরতাম। এরপর চলত পুকুরের গোপ বানানোর খেলা। পানিতে ডুবোতে ডুবোতে কার কতটা গোপ কাল করা যায় সে প্রতিযোগিতা।

প্রতিদিনের এই খেলার সাথীরা ছিল একজন আরেকজনের প্রাণের বন্ধু। কোন দিন কেউ খেলতে না আসলে সবাই মিলে তার বাসায় চলে যাওয়া। কেউ অসুস্থ হলে সবাই মিলে তাকে সেবা করা। যে কোন কাজে একে অপরকে সাহায্য করা। একসাথেই চলতো সব।

জীবনের প্রায় একযুগ সময় যাদের কাছে কাটিয়েছি। একটি বৈশাখী দুপুর যাদের সাথে না খেলা করলে সময়ই কাটতো না। আজ তাদের সবার নামও বলা সম্ভব নয়। তাদের চেহারাগুলোও আজ ঝাপসা লাগে।

আধুনিকতা আজ সব কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে খেলার মাঠ। বৈশাখের দুপুর। শৈশব-কৈশোরের সেই নির্মল আনন্দগুলো। আজকের ঢাকায় বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের কাছে এটা রুপকথার গল্প মনে হতে পারে। তবুও, এই যান্ত্রিকতার ভিড়ে ছোট বেলার সেই খেলার সাথীদের আজো মনে পড়ে। আর মনের মাঝে বেজে গুন গুন করি, “খেলার সাথীরা কোথা আজ তারা?” এই পঙক্তিটি।

শব্দ লেখকঃ তরিকুল ইসলাম

মামলা-মোকাদ্দমা নয়, ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করুন

মামলা-মোকাদ্দমা নয়, ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করুন

কেউ যখন ধর্ষণ নামক পৈশাচিক অপকর্মটি করে, সে শুধু ওই নারী বা পরিবারের ক্ষতি করে না। সে সমগ্র সমাজের মূল্যবোধে আঘাত হানে। সমাজে বিরাজমান মানুষে মানুষে যে পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসা। সেটাকে আঘাত করে। তাই, ধর্ষণকে শুধু ফৌজদারি বা নারী শিশু আদালতে নয়। ওই পিশাচদের সামাজিক আদালতে দাঁড় করাতে হবে। কারণ, আইন আদালতের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে নিজেদের প্রাশ্চিত্ত হয়েছে বলে মনে করে ওরা। আবারো সমাজের স্রোতে মিশে গিয়ে ওরা অন্যদের উৎসাহিত করে। এমন উদাহরণ আমাদের দেশে অনেক আছে। গত একমাসের ঘটনা লক্ষ্য করলে সেটা স্পষ্ট দেখা যায়।

অথচ পরিবার ও সমাজচ্যুতিই ওদের প্রাপ্য শাস্তি ছিল। আদালত অন্ধ। কিন্তু পরিবার ও সমাজ জাগ্রত স্বত্বা। পরিবার ও সমাজ যেমন তাকে আশ্রয় দিয়ে এমন পর্যায়ে এনেছে। তাই, পরিবার ও সমাজ এই অন্যায়ের দায় এড়াতে পারে না। এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদেরকেও এর দায়ভার নিতে হবে।

মামলা করবেন তো প্রথমেই ‘তদন্ত কমিটি’। এর পর শুরু হবে সেই মহান তদন্ত, ময়না তদন্ত। লাশ উঠাও লাশ, লাশ গাড়ো, লাশ উঠাও লাশ গাড়ো ফর্মুলার বাস্তবায়ন। এভাবেই চলবে কয়েক দফা। এরপর মিলবে রিপোর্ট। রিপোর্ট আর আসেনা…। অবশেষে আসলেও সে কর্মের জন্য দায়ী তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাই।

অপরাধ দমন বা অপরাধীকে সংশোধন আদালত দিয়ে হয় না। কারণ, আদালতের আছে কিছু লিখিত নিয়ম-কানুন। সে ওটা দিয়েই সব বিচার করে। এ ধারাই পড়েনি তো ও ধারাই পড়েছে—এই হল বিচারের মাপকাঠি। আইনের আরো বড় সীমাবদ্ধতা আছে। সেটা যুগের তালে অতটা পাল্টাই না, যতটা পাল্টালে নব্য অপরাধীদের ধরা যায়।

মানুষ-অপরাধীকে ধারা দিয়ে ধরা যায় না। এ বুদ্ধিমান প্রাণীকে ধরতে আরো উন্নত ফর্মুলা প্রয়োজন। সমাজ ও পরিবারই হতে পারে তার উত্তম মাধ্যম। সমাজের হাতেই আছে এই ঘৃণ্য অপরাধীদের দমনের জন্য উত্তম হাতিয়ার। সামজিকভাবে বয়কট করলেই ওদের প্রাপ্য শাস্তি হবে।

আমাদের শুধুমাত্র ওদের শাস্তি দিলেই হবেনা। মানুষ মরে গেলে পচে যায়। শেষ হয় তার সমস্ত। বরং সেটা কারো কারো মনে সিম্প্যাথির উদয় করে। কারণ, মৃত্যু হল এমন বিষয় যা মানুষ মাত্রই তাকে ব্যাকুল করে তোলে। তাই, আমাদের এমন কিছু করতে হবে যা অন্যের জন্য উদাহরণ হতে পারে।

শব্দ লেখকঃ তরিকুল ইসলাম

‘নারী-নিরাপত্তা’ বলে আলাদা কিছু নেই

‘নারী-নিরাপত্তা’ বলে আলাদা কিছু নেই

নিরাপত্তাহীনতার কোন জাতপাত বা লিঙ্গ ভেদ নেই। আর সেটা যদি হয় সামাজিক। তাহলে সেই সমাজে থাকা সবার জন্যই সেটা প্রযোজ্য। আমাদের এখানে এখন ‘নারী-নিরাপত্তা’ বলে একটি নতুন প্রপঞ্চের বেশ ব্যবহার হচ্ছে। এ প্রপঞ্চের মুল কথা হল- নারীর জন্য আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রকৃত অর্থে কোন সমাজে যখন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয় সামনে আসে। তখন সেটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। ব্যক্তি বা লিঙ্গ ভেদে তা হয় না। ধরুন ঢাকার কোন নির্জন গলি দিয়ে রাত একটার দিকে আপনি হাটছেন। একাকী। বিপদে কাউকে পাওয়ার ও সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় আপনি কী ঘাবড়ে যাবেন না? আপনার কি ভয় লাগবে না? নিশ্চয় লাগবে। ভয়ের কারণ কী? কারণ, যে কোন সময় কোন ছিনতাইকারী বা অপরাধী আপনার সামনে এসে পড়তে পারে। ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে আপনার মূল্যবান সব কিছু। এমনকি আপনাকে আহত বা খুন ও করতে পারে। এমন ভাবার কারণ হল- আপনি জানেন যে, এই শহরে এমনটি আহরহই ঘটছে। আপনি এই শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু আপানার যায়গায় যদি একজন নারী হয়? সে অবস্থায় সে তো নিরাপদ নয়ই। কারণ, অমন কোন যুবক বাড়তি হিসেবে চাইবে তাঁর সম্ভ্রম ছিনতাই করতে। এরাও ছিনতাই কারী। এদের ছিনতাইকারী বলছি কারণ, এরা সমাজের মূল্যবোধ ছিনতাই করে। এমতাবস্থায়, সবাই তাঁর এতো রাতে বাইরে কী এই প্রশ্নই তুলবেন। আসলে বিষয়টা তা নয়। আসল ব্যাপার হল নিরাপত্তাহীনতা।  আমরা কেউই নিরাপদ নই। নিরাপদ নয় আমাদের পরিবার। আমাদের সন্তান-সন্ততি।

নারীর প্রতি আমাদের আচরণ মুল্যবোধেরও মাফকাঠি। নারীর সম্ভ্রম হানী হলে সেটা ওই বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবারের জন্যই ক্ষতি বা লজ্জার নয়। সেটা পুরো সমাজ বা দেশের জন্য লজ্জার, অপমানের।

নিরাপত্তা একটি সমাজের মেরুদণ্ড। সমাজের নিরাপত্তা যত শক্তিশালী হয় সমাজের মেরুদণ্ড ও তত শক্তিশালী হতে থাকে। নিরাপদ সমাজ মানেই, শক্ত মেরুদণ্ডের সমাজ। আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। আমরা যদি এখনি সজাগ না হই, এই ভঙ্গুর সমাজে চাঁপা পড়েই মরতে হবে আমাদের।

তাই শুধু ‘নারী-নিরাপত্তা’ নয়, সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। আর সেটা করতে পারলেই আমাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

লেখকঃ তরিকুল ইসলাম

 

 

নারীর ওপর আঘাত মানেই সমাজের মননশীল ভিত্তিতে আঘাত

নারীর ওপর আঘাত মানেই সমাজের মননশীল ভিত্তিতে আঘাত

tonu“সে যুগ হয়েছে বাসি,

যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো,

নারীরা আছিল দাসী,” কাজী নজরুল তাঁর নারী কবিতায় এমনটিই ভেবেছিলেন। কিন্তু বাস্তাবে সেটি কতদূর? আমাদের সমাজ কি সে অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছে? আদৌ কী আমাদের সমাজ সেটির জন্য প্রস্তুত? যদি নাই হবে, তাহলে আর কতদূর? এই সমাজে আর কত বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে নারীকে?

একটি সমাজে কতটা সহনশীল, কতটা সভ্য। তা সে সমাজে বসবাসকারী নারীদের প্রতি সমাজের মানুষের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বোঝা যায়। একটা সমাজ বসবাসের জন্য কতটা উপযুক্ত তারও মাফকাঠি সেই নারী। নারীর ওপর আঘাত মানেই সমাজের সবচেয়ে মননশীল ও অহিংস ভিত্তির ওপরই আঘাত। মৃত্যু মুখাপেক্ষী একটি সমাজের কফিনে এইটিই শেষ পেরেক বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই ধরনের আঘাত তখনি আসতে শুরু করে যখন সে সমজের পতন শুরু হয়। তখনি নারীর উপর বর্বরতা আসে, যখন সমাজের অপশক্তির উপাদানগুলো উঠান ডিঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।

নারীর ওপর আরবদের বর্বরতার কথা শুনেছি আমারা। সে সমাজে নারীকে জীবন্ত কবর দেওয়ার কথাও জানা যায়। এমন অবস্থা তখনি ঘটেছিল যখন সেটি বর্বরতা শেষ বিন্দুতে পৌঁছে। নারীর ওপর আঘাত আসতে থাকা মানেই, পতনের শুরু। আমারা কি সেই পতনোম্মুখ?

সেটা না হয় হল। তবে, এর পেছনের কারণটা কি কখন ভেবে দেখেছি? কেন এমনভাবে আমরা আমাদের মানসিক মননশীলতা হারাচ্ছি? কেনই বা আমাদের নৈতিকতা এমন বাজেভাবে মার খাচ্ছে? হয়তোবা এর উত্তর দেওয়ার জন্য আমারা আজো প্রস্তুত নই। প্রস্তুত নেই বলেই সোহাগীদের মা-বাবাদের এখনো বিচারের অপেক্ষায় থাকতে হয়। বিচার চাইলে তাদের মৃত্যুর হুমকি পেতে হয়। বিচারের জন্য ঘুরতে হয় দুয়ারে দুয়ারে। অন্যপক্ষে, দোষীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সমাজকে শাসায়। শাসন করে।

এর উত্তর আমাদের খুঁজতেই হবে। এই সামাজিক অসভ্য উপাদানের মূলোৎপাটন করতেই হবে। না হলে কারোর রেহাই নেই।

নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর হত্যার প্রতিবাদে দেশের কিছু মানুষ সংঘবদ্ধ হতে চলেছে। গুটি কয়েক মানুষ নিয়মিত সোহাগীর বিচারের জন্য কর্মসূচী করে যাচ্ছে। গুটি কয়েক মানুষ বলছি কারণ কোটি কোটি বুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকের তুলনায় সেটা সামান্যই। প্রশ্ন হল- কেন সবাই নয়? এমন স্পস্ট অন্যায়ের প্রতিবাদেও কেন আমরা পিছপা?

সাবধান। এটিই শেষ নয়। তোমারা যারা ঘরে বসে আছো। তোমরাও রেহাই পাবেনা। কারণ, সামাজিক বর্বরতা কোন নিয়ম মেনে চলেনা। তুমিও কোন নারীর সন্তান, কোন নারীর ভাই অথবা কোন নারীর প্রিয়তম স্বামী। তোমার ঘরে নারী আছে। কোন নারীর প্রিয় মমতায় তোমার সকালটা সুন্দর হয়ে উঠে। আজ যদি আমারা না পারি। এ বিপদ আমাদের সাবাইকে গ্রাস করবে।

এরকম ঘটনা ঘটলেই কেউ কেউ রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বিক্ষুদ্ধ হয়। কিন্তু রাষ্ট্র কি আমা বিনা ভিন্ন কিছু? রাষ্ট্রের কী আলাদা কোন ক্ষমতা আছে আদৌ? না। নেই। রাস্ত্রের স্বতন্ত্র কোন ক্ষমতা নেই। প্রাথমিক সমাজ বিজ্ঞ্যানের ভাষায়- কয়েকজন জন মানুষ নিয়ে পরিবার। এই পরিবারের সমষ্টি একটি সমাজ। আর সেই সমাজের বৃহৎ পর্যায় হল   রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সেই সমাজের ভেতরটাকে প্রতিফলিত করে। তবে, একথাও সত্য যে, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কেন্দ্রীক রাষ্ট্র হতে পারে। তবে, সেটা ক্ষণস্থায়ী। সেটাও জনগণের ম্যান্ডেট মানতে বাধ্য থাকে। সবকিছু নির্ভর করে আমদের স্বদিচ্ছার ওপর। আসুন ভেতরের মননশীলতাকে জাগিয়ে তুলি। রাষ্ট্রের কথা চিন্তা না করে নিজেরাই রুখে দেই এসব ধ্বংসাত্মাক উপাদান। তাদের দাম্ভিক বিচরণ।